দরসে কুরআন- পর্ব- ১ কোরআনে দান সদাকার ফজিলত

 


দান-সদাকার বিষয় সূরায়ে বাকারার কিছু আয়াত এবং সেগুলোর সংক্ষিপ্ত তাফসীর। আল্লাহতালা এরশাদ করেন,

২৫৪.হে মুমিনগণ! আমি তোমাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে সেই দিন আসার আগেই (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর, যেদিন কোনও বেচাকেনা থাকবে না, কোনও বন্ধুত্ব (কাজে আসবে) না এবং কোনও সুপারিশও না। আর যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তারাই জালিম।

২৬১.যারা আল্লাহর পথে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত এ রকম যেমন একটি শস্য দানা সাতটি শীষ উদগত করে (এবং) প্রতিটি শীষে একশ দানা জন্মায়। আর আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন (সওয়াবে) কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় (এবং) সর্বজ্ঞ।

তাফসীরঃ অর্থাৎ আল্লাহর পথে খরচ করলে সাতশ গুণ সওয়াব পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা যাকে চান তাকে আরও অনেক বেশি দেন। প্রকাশ থাকে যে, কুরআন মাজীদে আল্লাহর পথে ব্যয় করার কথা বারবার বলা হয়েছে। এর দ্বারা এমন যে-কোন অর্থব্যয়কে বোঝানো হয়েছে, যা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য ব্যয় করা হয়। যাকাত, সাদাকা ও দান-খয়রাত সবই এর অন্তর্ভুক্ত।

২৬২.যারা নিজ সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে, আর ব্যয় করার পর খোঁটা দেয় না এবং কোনরূপ কষ্টও দেয় না, তারা নিজ প্রতিপালকের কাছে তাদের সওয়াব পাবে। তাদের কোনও ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না।

২৬৩.উত্তম কথা বলে দেওয়া ও ক্ষমা করা সেই সদাকা অপেক্ষা শ্রেয়, যার পর কোনও কষ্ট দেওয়া হয়।আল্লাহ অতি বেনিয়ায, অতি সহনশীল।

তাফসীরঃ অর্থাৎ কোনও সওয়ালকারী যদি কারও কাছে চায় এবং সে কোনও কারণে দিতে না পারে, তবে তার উচিত নম্র ভাষায় তার কাছে ক্ষমা চাওয়া। আর সে যদি অনুচিত পীড়াপীড়ি করে, সেজন্য তাকে ক্ষমা করা। আর এই কর্মপন্থা সেই দান অপেক্ষা বহু শ্রেয়, যে দানের পর খোটা দেওয়া হয় কিংবা অপমান করে কষ্ট দেওয়া হয়।

৩৬৪.হে মুমিনগণ! খোটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদাকাকে সেই ব্যক্তির মত নষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এ রকম যেমন এক মসৃণ পাথরের উপর মাটি জমে আছে, অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং তা (সেই মাটিকে ধুয়ে নিয়ে যায় এবং) সেটিকে (পুনরায়) মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে, তার কিছুমাত্র তারা হস্তগত করতে পারে না। আর আল্লাহ (এরূপ) কাফিরদেরকে হিদায়াতে উপনীত করেন না।

তাফসীরঃ বড় পাথরের উপর মাটি জমলে তার উপর কোনও জিনিস বপণ করার আশা করা যেতে পারে, কিন্তু বৃষ্টি যদি মাটিকে ধুয়ে নিয়ে যায়, তবে মসৃণ পাথর কোনও চাষাবাদের উপযুক্ত থাকে না। এভাবে দান-খয়রাত দ্বারা আখিরাতে সওয়াব পাওয়ার আশা থাকে, কিন্তু সে দান-খয়রাত যদি করা হয় মানুষকে দেখানোর ইচ্ছায় এবং তারপর খোঁটাও দেওয়া হয়, তবে তা দান-খয়রাতকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে সওয়াবের কোনও আশা থাকে না।

২৬৫. আর যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এবং নিজেদের মধ্যে পরিপক্বতা আনয়নের জন্য, তাদের দৃষ্টান্ত এ রকম যেমন কোনও টিলার উপর একটি বাগান রয়েছে, তার উপর প্রবল বৃষ্টিপাত হল, ফলে তা দ্বিগুণ ফল জন্মাল। যদি তাতে প্রবল বৃষ্টি নাও পড়ে, তবে হালকা বৃষ্টিও (তার জন্য যথেষ্ট)। আর তোমরা যা-কিছু কর, আল্লাহ তা অতি উত্তমরূপে দেখেন।

তাফসীরঃ অর্থ-সম্পদের মোহ মানুষের স্বভাবজাত। তাই তা ব্যয় করা অন্যসব ইবাদত অপেক্ষা বেশি কঠিন। এতে মনের উপর অত্যন্ত চাপ পড়ে। সে চাপকে উপেক্ষা করে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করতে থাকলে এক পর্যায়ে মন ঈমানী চেতনার সামনে বশ্যতা স্বীকার করে। ফলে ঈমান-আমলে দৃঢ়তা ও পরিপক্কতা লাভ সহজ হয়ে ওঠে।

২৬৬. তোমাদের মধ্যে কেউ কি এটা পছন্দ করবে যে, তার খেজুর ও আঙ্গুরের একটা বাগান থাকবে, যার পাদদেশ দিয়ে নদী-নালা প্রবাহিত থাকবে (এবং) তা থেকে আরও বিভিন্ন রকমের ফল তার অর্জিত হবে, অতঃপর সে বার্ধক্য-কবলিত হবে আর তার থাকবে দুর্বল সন্তান-সন্ততি, এ অবস্থায় অকস্মাৎ এক অগ্নিক্ষরা ঝড় এসে সে বাগানে আঘাত হানবে, ফলে গোটা বাগান ভস্মিভূত হয়ে যাবে? ২০৪ এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় আয়াতসমূহ পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা কর।

তাফসীরঃ দান-খয়রাত নষ্ট করার এটা দ্বিতীয় উদাহরণ। অগ্নিপূর্ণ ঝড় যেভাবে সবুজ-শ্যামল বাগানকে মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করে ফেলে, তেমনিভাবে মানুষকে দেখানোর জন্য দান করলে বা দান করার পর খোটা দিলে কিংবা অন্য কোনওভাবে গরীব মানুষকে কষ্ট দিলে তাতে দান-খয়রাতের বিশাল সওয়াব বরবাদ হয়ে যায়।

২৬৭.হে মুমিনগণ! তোমরা যা-কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা-কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। আর এরূপ মন্দ জিনিস (আল্লাহর নামে) দেওয়ার নিয়ত করো না যা (অন্য কেউ তোমাদেরকে দিলে ঘৃণার কারণে) তোমরা চক্ষু বন্ধ না করে তা গ্রহণ করবে না। মনে রেখ, আল্লাহ বেনিয়ায, সর্বপ্রকার প্রশংসা তাঁরই দিকে ফেরে।

ব্যাখ্যাঃ পূর্বোক্ত আয়াত সমূহে দান-খয়রাত কবূল হওয়ার জন্য শর্ত জানা যায়। (১) সম্পদ হালাল হওয়া, (২) সুন্নাহ অনুযায়ী ব্যয় করা, (৩) ছহীহ্‌ খাতে ব্যয় করা, (৪) দান করে অনুগ্রহ প্রকাশ না করা (৫) গ্রহীতাকে হেয়-প্রতিপন্ন না করা এবং অন্য কোনভাবে কষ্ট না দেয়া ও (৬) বিশুদ্ধ নিয়তে একমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য দান করা।

২৬৮.শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে অশ্লীলতার আদেশ করে, আর আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় মাগফিরাত ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ অতি প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।

২৬৯.তিনি যাকে চান জ্ঞানবত্তা দান করেন, আর যাকে জ্ঞানবত্তা দান করা হল, তার বিপুল পরিমাণে কল্যাণ লাভ হল। উপদেশ তো কেবল তারাই গ্রহণ করে, যারা প্রজ্ঞার অধিকারী।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কোরআনুল কারীমের উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করার তৌফিক দান করুন।

-মোহাম্মদ মারুফ বিল্লাহ

মুহাদ্দিস: দারুল উলুম ফজলিয়া কওমিয়া মাদ্রাসা।

৮ ই রমযানুল মুবারক, ১৪৪৫ হিজরী,

মোতাবেক: ১৯-৩- ২০২৪ ঈসায়ী।

0 মন্তব্যসমূহ